প্রকাশিত: ৯ অক্টোবর ২০২৫
এক সময় ধারণা ছিল— যত বেশি দেশ ভ্রমণ করা যাবে, পাসপোর্ট তত ‘শক্তিশালী’। কিন্তু এখন সেই বাস্তবতা উল্টো। সবুজ মলাটের বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিশ্বজুড়ে যেন এক প্রকার ‘অ্যালার্জি’ তৈরি হয়েছে। উন্নত দেশ তো বটেই, এমনকি যেসব দেশ আগে ভিসা অন-অ্যারাইভাল সুবিধা দিত, সেখান থেকেও অনেক বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
উন্নয়নশীল দেশেও ভিসা পাওয়া কঠিন
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জনপ্রিয় গন্তব্য থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে এখন ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। এসব দেশে ভিসা প্রক্রিয়ায় সময় লাগছে বেশি, প্রত্যাখ্যানের হারও বাড়ছে। এমনকি যাচাই-বাছাই শেষে ভিসা পেলেও অনেক বাংলাদেশিকে বিমানবন্দরে ‘অফলোড’ করে দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।
নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কার মতো পর্যটননির্ভর দেশগুলোও অন-অ্যারাইভাল ভিসা থাকা সত্ত্বেও অনেক বাংলাদেশিকে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না।
একসময় অন-অ্যারাইভাল ভিসা দেওয়া ইন্দোনেশিয়া এখন কঠোর নিয়মে ভিসা দিচ্ছে; বহু নথিপত্র ও ফি জমা দিতে হচ্ছে, তবু ভিসা নিশ্চিত নয়।
ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যে সীমিত ভিসা
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে ভারত নতুন করে ভিসা কার্যক্রম স্থগিত রেখেছে। বর্তমানে কেবল মেডিকেল ভিসা সীমিত আকারে দেওয়া হচ্ছে।
একইভাবে দুবাই ও আবুধাবিতেও নতুন ভিসা প্রদান স্থগিত আছে বলে জানা গেছে।
কেন অনীহা বাংলাদেশি পাসপোর্টে?
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূল কারণ হলো ভিসার অপব্যবহার ও অবৈধ অভিবাসন। অনেকেই পর্যটন ভিসায় বিদেশ গিয়ে আর দেশে ফেরেন না। কেউ কেউ সেই দেশ থেকে অন্য দেশে অবৈধভাবে পাড়ি জমান।
উদাহরণ হিসেবে মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন জানায়, ফেরত পাঠানো অনেক বাংলাদেশির হোটেল বুকিং ছিল ভুয়া, আর অনেকের কাছে পর্যাপ্ত ভ্রমণ ব্যয়ও ছিল না। কেউ কেউ আত্মীয়ের বাড়িতে থাকার অজুহাত দিলেও ঠিকানা বা আমন্ত্রণপত্র দিতে পারেননি।
বাংলাদেশ পুলিশের ইমিগ্রেশন বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন,
“দালালরা অনেক যাত্রীকে ভুল বুঝিয়ে ট্যুরিস্ট ভিসায় বিদেশ পাঠায়। তারা অবৈধভাবে ইমিগ্রেশন পার হওয়ার নানা কৌশল শেখায়। এ কারণে মালয়েশিয়া এখন বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেখলেই অতিরিক্ত সতর্ক।”
থাই ভিসা পেতে লাগছে ৪৫ দিন
পর্যটননির্ভর থাইল্যান্ড এখন বাংলাদেশিদের ভিসা দিতে ৪৫ দিন পর্যন্ত সময় নিচ্ছে। আবেদনকারীর ব্যাংক স্টেটমেন্ট, সলভেন্সি সার্টিফিকেট, ট্রেড লাইসেন্সসহ ডজনখানেক নথি জমা দিতে হয়। ট্যুর অপারেটরদের অভিযোগ, থাইল্যান্ডে এখন বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক দীর্ঘসূত্রিতা চলছে।
নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপেও বাড়ছে জিজ্ঞাসাবাদ
নেপাল ও শ্রীলঙ্কা আগে সহজে বাংলাদেশিদের প্রবেশাধিকার দিলেও এখন তারা ইমিগ্রেশনে নানা প্রশ্ন করছে। অনেক নতুন পাসপোর্টধারী ভ্রমণ অভিজ্ঞতা না থাকায় সন্দেহের মুখে পড়ছেন। কেউ কেউ ভুয়া হোটেল বুকিং দেখালে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা পাচ্ছেন।
একই পরিস্থিতি মালদ্বীপেও। হোটেল বুকিং প্রমাণ বা থাকার জায়গার কাগজ না থাকায় অনেক বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।
ট্যুর অপারেটরদের ক্ষতি
টোয়াব সভাপতি রাফিউজ্জামান রাফি বলেন,
“পর্যটনবান্ধব প্রতিবেশী দেশগুলো ভিসা বন্ধ করে দিয়েছে। ভারত, কাতার, বাহরাইন, দুবাই, ভিয়েতনাম— সব জায়গায় জটিলতা বেড়েছে। এতে পর্যটক কমে গেছে, ট্যুর অপারেটররাও ক্ষতিগ্রস্ত।”
তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, কূটনৈতিকভাবে বিষয়টি দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিতে।
দুই দশকে শক্তিশালী থেকে দুর্বল
লন্ডনভিত্তিক হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের পাসপোর্ট সূচক অনুযায়ী ২০০৬ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৬৮তম। এখন নেমে এসেছে ৯৪তম স্থানে— ফিলিস্তিন ও ইরিত্রিয়ার সঙ্গে সমান অবস্থানে।
সাবেক রাষ্ট্রদূতের মতামত
চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ বলেন,
“অনেক বাংলাদেশি পর্যটন ভিসা নিয়ে অবৈধভাবে থেকে কাজ করেন, ফলে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। আমরা যদি নিজেদের আচরণ ও আইন মানার সংস্কৃতি উন্নত করি, তবে আবারও বিশ্বে পাসপোর্টের মর্যাদা ফিরতে পারে।”
সূত্র: ঢাকা পোস্ট, রয়টার্স, দ্য স্ট্রেইটস টাইমস, হেনলি রিপোর্ট ২০২৫










