জরুরি অবস্থার ঘোষণা, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ও মানবাধিকার সুরক্ষায় নতুন সাংবিধানিক দিকনির্দেশনা; সনদে আওয়ামী লীগের নাম উল্লেখ করে পঞ্চম ধারায় বিতর্কিত সংশোধনী
নিজস্ব প্রতিবেদক | ১৮ অক্টোবর ২০২৫:
দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গণঅভ্যুত্থানপরবর্তী বৃহত্তম রাজনৈতিক সমঝোতা হিসেবে বিবেচিত ‘জুলাই সনদ’-এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি নতুন নীতিগত ও সাংবিধানিক প্রস্তাবনা, যা বিদ্যমান সংবিধান ও প্রশাসনিক কাঠামোয় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
গত শুক্রবার বিকেলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা এই জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেন, যা ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে জনগণের রক্ত ও ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রচিত রাজনৈতিক অঙ্গীকারনামা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
জরুরি অবস্থার ক্ষমতা সীমিত, যুক্ত হচ্ছে নতুন শর্ত
বিদ্যমান আইনে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা জারি করতে পারেন। কিন্তু জুলাই সনদ অনুসারে, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে।
সনদে বলা হয়েছে—
জরুরি অবস্থা জারি করতে হলে মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিরোধীদলীয় নেতা অথবা তাঁর পরিবর্তে উপনেতার উপস্থিতি ও সম্মতি প্রয়োজন হবে।
এছাড়া সংবিধানের ১৪১(ক) অনুচ্ছেদে সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যেখানে “অভ্যন্তরীণ গোলযোগ” শব্দের পরিবর্তে যুক্ত হচ্ছে:
“রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার প্রতি হুমকি, মহামারি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ।”
জরুরি অবস্থার সময়েও নাগরিকের জীবন ও বিচার সংক্রান্ত অধিকার রক্ষার নিশ্চয়তা দিতে বলা হয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫ ও ৪৭(ক)-এর আলোকে জীবন ও ন্যায়বিচারের অধিকার খর্বযোগ্য নয় বলেও সনদে উল্লেখ রয়েছে।
প্রধান বিচারপতি নিয়োগে যুক্ত হচ্ছে সিনিয়রিটি ভিত্তিক বাধ্যবাধকতা
বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিলেও বাস্তবে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাই নির্ধারণমূলক ছিল। দীর্ঘদিন ধরেই এ নিয়ে সমালোচনা রয়েছে।
জুলাই সনদে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে যে,
“আপিল বিভাগের সবচেয়ে সিনিয়র বিচারপতিকেই প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে।”
তবে বিএনপি একটি ‘নোট অব ডিসেন্ট’ যুক্ত করে বলেছে, তারা ক্ষমতায় গেলে আপিল বিভাগের সর্বোচ্চ দুইজনের মধ্য থেকে কাউকে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ রেখে সংবিধান সংশোধন করবে।
পঞ্চম ধারায় বিতর্কিত সংশোধন
জুলাই সনদের সবচেয়ে আলোচিত অংশ হলো এর পঞ্চম ধারা, যেখানে গণঅভ্যুত্থানকালে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড, গুম, নির্যাতনের বিচার ও শহীদ পরিবারদের সহায়তার প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
প্রথম খসড়ায় এই ধারা ছিল তুলনামূলকভাবে নিরপেক্ষ:
“১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানে নিহতদের বিচার ও শহীদ পরিবারকে সহায়তা।”
তবে চূড়ান্ত সংস্করণে আওয়ামী লীগের নাম উল্লেখ করে আরো রাজনৈতিক ভাষ্য যুক্ত করা হয়েছে, যেমন:
“ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার… শহীদ পরিবার ও আহত বীর যোদ্ধাদের আইনগত দায়মুক্তি, মৌলিক অধিকার সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবো।”
এই সংশোধনী নিয়ে ইতোমধ্যেই রাজনৈতিক অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
বিশ্লেষণ: নতুন দিকনির্দেশনা, নাকি নতুন বিতর্ক?
বিশ্লেষকরা বলছেন, জুলাই সনদের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ সংবিধান সংশোধনের একটি রূপরেখা তৈরি হলো, যেখানে ক্ষমতার ভারসাম্য, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকারকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
তবে বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন,
“রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক আস্থা ও বাস্তব প্রয়োগ ছাড়া এই সনদ কাগুজে অঙ্গীকারই থেকে যেতে পারে।”
অ্যাটর্নি জেনারেলের মন্তব্য
এদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন,
“জুলাই সনদ নিয়ে তর্ক না করাই শ্রেয়। পরিবর্তনের সুযোগ আছে। বাস্তবায়ন বানচাল হলে দেশ পিছিয়ে পড়বে।”
তিনি আরও বলেন,
“সনদ বাস্তবায়নে দেরি হলেও জুলাই হত্যার বিচার স্বাভাবিক গতিতেই চলবে, বাধাগ্রস্ত হবে না।”
সংক্ষেপে জুলাই সনদের আলোচিত বিষয়গুলো
| বিষয়ের নাম | প্রস্তাবিত পরিবর্তন |
|---|---|
| জরুরি অবস্থা | বিরোধীদলের সম্মতি সাপেক্ষে জারি |
| ১৪১(ক) অনুচ্ছেদ | ‘অভ্যন্তরীণ গোলযোগ’ শব্দ বাদ |
| মৌলিক অধিকার | জীবন ও বিচারের অধিকার খর্ব নয় |
| প্রধান বিচারপতি | সিনিয়র বিচারপতির নিয়োগ বাধ্যতামূলক |
| শহীদ পরিবার | রাষ্ট্রীয় মর্যাদা, ভাতা, পুনর্বাসন |
| আইনি দায়মুক্তি | আহত বীর যোদ্ধা ও পরিবারদের জন্য |
| বিতর্কিত সংশোধন | আওয়ামী লীগের নাম উল্লেখ করে দায় নির্দিষ্টকরণ |










